চাঁটগাইয়া আঞ্চলিক গান.অতীত বর্তমান ও ভবিষ্যত. (১ম পর্ব)
লিখেছেন লিখেছেন চাটগাইয়া নওজোয়ান ০৫ জানুয়ারি, ২০১৬, ০৯:১৩:২৯ রাত
১৯৯১ সালের এক শীতের সকাল বেলা..
আমি প্রতিদিনের ন্যায় দুবাই নগরের কেন্দ্রস্থল দেরা'র ফিরিজ আল মুরার'স্থ দোকানে কর্মব্যাস্ত সময় পার করছিলাম, হঠাৎ মাইকে উচ্চস্বরে গান শুনে দুইকান খাড়া হয়ে গেল আমি অবাক না হয়ে পারিনি ...
কারণ যেই সেই গান নয়, একেবারে বিশুদ্ধ চাঁটগাইয়া আঞ্চলিক গান, তাও আবার দুবাই'র মত শহরে. যেখানে অযথা গাড়ীর হর্ণ বাজালেও কৈফিয়ত দিতে হয় সেখানে মাইকে চাঁটগাইয়া গান শুনে মনে হচ্ছিল স্বপ্ন দেখছি, নিজেকে ধরে রাখতে পারলাম না . দৌড়ে বের হলাম কোথায় গান হচ্ছে দেখার জন্য ..
আমার অতি উৎসাহের কারণ দুটি, প্রথম:ত আমি একজন চাঁটগাইয়া প্রবাসী, দ্বিতীয়ত মাইকে যে গান বাজছে সে গান শুনেছিলাম একদম শৈশবে, (বন্ধু আঁর দুয়ারদি য. আঁরল হতা কা নহ ) এই গানগুলি চট্টগ্রাম জেলার গ্রামঞ্চলে বিয়েশাদীতে বাজতো. আমি গানের আওয়াজ শুনে কিছুক্ষণের মধ্যেই গানের স্থান খুজে পেলাম দেখলাম একটি একতলা ঘরের ছাদে দুইটি মাইক লাগিয়ে গান বাজানো হচ্ছে. ওখানে অনেক লোকের সমাগম প্রায় সবাই বাঙালী বলে মনে হলো কয়েকজন আরবী যুবককেও দেখা গেল বিস্তারিত খোঁজ নিয়ে জানলাম বিগত ৪০/৪৫ বছর ধরে কক্সবাজারের টেকনাফ অঞ্চলের প্রায় লক্ষাধিক মানুষ এখানে সপরিবারে বসবাস করেন. তাদের বিয়ে শাদী এবং অন্যান্য সামাজিক অনুষ্ঠান হয় নিজেদের মধ্যেই. এটি এরকমই একটি বিয়ের অনুষ্ঠান. তাদের বিয়ের অনুষ্ঠানে এভাবেই নিজের অঞ্চলের মত তারা আনন্দ করে থাকেন..
আমি চট্টগ্রামের বাসিন্দা জেনে আমাকেও দাওয়াত করা হলো সেই বিয়েতে সবান্ধব গিয়েছিলাম প্রচুর আনন্দ করেছিলাম তবে আজ সেই প্রসঙ্গ নয়. শুরু করেছিলাম চট্টগ্রামের আঞ্চলিক গান দিয়ে তাই নিয়ে আলোকপাত করব. আমার জম্ম চট্টগ্রাম শহরে. আমার পূর্ব পুরুষেরা এই শহরের স্থায়ী বাসিন্দা. দক্ষিণ চট্টগ্রামের আধুনগরে আমার মামার বাড়ী. গ্রামের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য এবং তাদের সরল আথিতিয়েতায় আমি আশৈশব মুগ্ধ যা অদ্যবধি অক্ষুন্ন রয়েছে .
ছোটবেলায় মামার বাড়ীতে বেড়াতে গেলে আনন্দ ফুর্তিতেই কেটে যেত সারাবেলা. এই আনন্দ আরো পূর্ণতা লাভ করতো যদি কোন বিয়ের অনুষ্ঠান হতো কারণ বিয়ের অনুষ্ঠান মানেই বিয়ের আগের রাতের গান বাজনা, এসব আসরে সাধারণত চট্টগ্রামের আঞ্চলিক গানের প্রাধান্য থাকতো. স্থানীয় অপরিপক্ক শিল্পীদের নিয়ে সারারাত অর্থাৎ ভোর হওয়ার আগ মূহুর্ত পর্যন্ত চলত এই আয়োজন. ভোরের আলো ফোটার পর থেকে দুপুর পর্যন্ত মাইকে বাজত শেফালী ঘোষ ও শ্যাম সুন্দর বৈষ্ণবের রেকর্ডের গান...
" আইলা অসমত বেইন্না ফজরত" "বন্ধু আঁর দুয়ারদি য. আঁরল হতা কা নহ" অথবা "অসম রেঙ্গুন ন যাইয়ু" তখনকার দিনে এই গানগুলি ব্যাপক জনপ্রিয়তা পেয়েছিল. সেই সময় থেকে চট্টগ্রামের আঞ্চলিক গান বাংলাদেশের সংস্কৃতির জগতে স্বমহিমায় নিজের আলাদা স্থান তৈরী করে নেয়. অতপর ধীরে ধীরে পরিপূর্ণ হতে থাকে চট্টগ্রামের আঞ্চলিক গানের ভান্ডার নতুন নতুন শিল্পীর আগমন ঘটতে থাকেনদীর স্রোতের ন্যায় দিন গড়িয়ে মাস মাস পেরিয়ে বছর যায় কর্ণফুলী ও শংখ নদীতে গড়িয়ে গেছে অনেক পানি ...
আমিও শৈশব পেরিয়ে কৈশোর ছাড়িয়ে, তারুণ্যে পদার্পন করি, ইতিমধ্যে আমার গানের পছন্দে যোগ হয়েছে বাংলা আধূনিক, ব্যান্ড, হিন্দী ছবির গান, উর্দূ গজল, কাওয়ালী ও পশ্চাত্যের রক ইত্যাদি. তবে চট্টগ্রামের আঞ্চলিক গানের পছন্দ ছিল সর্বাগ্রে .
১৯৯০ সালে জীবিকার উদ্দেশ্যে আমি সংযুক্ত আরব আমীরাতে চলে যাই. আপনজন হীন মরুময় প্রবাস জীবনে গান ছিল আমার অন্যতম বন্ধু প্রবাসে যাবার পর আমি পুরাতন ভারতীয় হিন্দী ও পুরাতন পাকিস্তানী উর্দূ সিনেমার গান এবং উর্দূ গজলের প্রতি আকৃষ্ট হয়ে পড়ি তবে নিজের সংগ্রহে থাকা সেই পুরাতন চট্টগ্রামের আঞ্চলিক গানের ক্যাসেটটি শুনতাম.আঞ্চলিক গানের নতুন কোন ক্যাসেটও সংগ্রহ করিনি তবে চট্টগ্রামের আঞ্চলিক গানের প্রতি আমার আগ্রহের বিন্দু মাত্র কমতি ছিল না. সুখে -দুঃখে আমার প্রবাস জীবন মোটামুটি ভালই কাটছিল. সারাদিন কাজ শেষে বাসায় ফিরে রান্না, অতপর খেয়েদেয়ে শুয়ে পড়া, তারপর দিনের কাজের প্রস্তুতি নেয়া এটাই রুটিন হয়ে গিয়েছিল. ছুটির দিন বলতে শুক্রবার. দুই অথবা তিন বছরে একবার দেশে আসা, এক দেড় মাস ছুটি কাটিয়ে কর্মস্থলে ফিরে যাওয়া,
এভাবেই চলছিল জীবন .
..... চলবে.....
বিষয়: বিবিধ
৩০৮৬ বার পঠিত, ১০ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
মাইট্টা কলসি তুরে লইয়া যা্ইয়ুম পানিরলাই
গলা ধরি সোহাগে বেরাই রে.. মাইট্টা কলসি তুরে লইয়া যা্ইয়ুম পানিরলাই.....
দজ্জের পারত হরৌই গাছ অরে বাতাস আইলে মারে গুজুরে, লাউয়ো বাপে বিয়ে দিল মারে দজ্জে'রো পুক কোলে।
চট্টগ্রামের আঞ্চলিক গানের এই ধারা এখন কমেযাচ্ছে একে রক্ষা করা প্রয়োজন।
মন্তব্য করতে লগইন করুন